বুধবার ০১ মে ২০২৪
Online Edition

মামলায় আসামী মৃত ব্যক্তি সাংবাদিক ও ছাত্রলীগকর্মী 

 

শ্রীনগর (মুন্সিগঞ্জ) সংবাদদাতা : মুন্সিগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন নজরুল ইসলাম বাচ্চু। মাস ছয়েক আগে তিনি মারা গেছেন। কিন্তু মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুর পুরাতন ফেরিঘাটে গত বুধবারের সংঘর্ষের মামলায় তাকে আসামী করেছে পুলিশ। সংঘর্ষ স্থলে না থাকলেও সাংবাদিক, জেলা ক্রীড়া সংগঠক, এমনকি ছাত্রলীগকর্মীকেও আসামী করা হয়েছে। তবে যুবদলকর্মী শহিদুল ইসলাম শাওন ভূঁইয়া নিহতের ঘটনায় মামলা হয়নি। ফেরিঘাট এলাকায় শ্রমিকলীগের কার্যালয় না থাকলেও অফিস ভাঙচুরের অভিযোগেও মামলা হয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে।

মুন্সিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মিনহাজ-উল-ইসলাম বলেন মুন্সিগঞ্জে বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষের ঘটনায় দায়ের করা দুই মামলায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আইনজীবী আব্দুস সালাম আজাদ, জেলা বিএনপির সদস্য সচিব কামরুজ্জামান রতনসহ ১৩৯ নেতাকর্মীকে আগাম জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিএনপি নেতা নিজাম মেম্বার ও শাহাদাত। সদর উপজেলা বিএনপি সভাপতি মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে এই জামিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। 

বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের অবকাশকালীন বেঞ্চ গতকাল বুধবার এই আদেশ দেন। আদালতে জামিন আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, মো. কামাল হোসেন ও রোকনুজ্জামান সুজা।

 বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশের ব্যানার কেড়ে নিলে সংঘর্ষ শুরু হয়। বিএনপি কর্মীদের ছোড়া ইটপাটকেলে অতিরিক্ত এসপিসহ ৩৩ পুলিশ সদস্য জখম হয়েছে। সংঘর্ষে আহত যুবদল কর্মী শাওন ভূঁইয়া পর দিন ঢাকা মেডিকেলকলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। মস্তিস্কে গুলীর আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে বলে হাসপাতালের সনদে বলা হয়েছে। তাকেও আসামী করা হয় বৃহস্পতিবার দায়ের করা পুলিশের মামলায়।

সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মাঈনউদ্দিন এবং শ্রমিকলীগ নেতা আবদুল মালেক বাদী হয়ে ১ হাজার ৩৬৫ জনকে আসামী করে দুটি মামলা করেছেন। পুলিশের মামলায় মুন্সিগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক আয়নাল হক স্বপন ১৪১ নম্বর আসামী। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, 'শহরের সবাই জানে- আমি রাজনীতিকরিনা। খেলাধুলা নিয়ে আমার দিনকাটে। ভুল করে আমাকে আসামী করেছে। বিষয়টি জানানোর পর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বুঝতে পেরেছেন।' শহরের পাঁচ ঘরিয়া কান্দি এলাকার হুমায়ুন কবীর দৈনিক খবর পত্রের জেলা প্রতিনিধি। তিনি জানান, দুর্ঘটনায় আঙুল ভেঙে যাওয়ায় ১৫ দিন ধরে তিনি বাড়িতে। কিন্তু দুই মামলাতেই তাকে আসামী করা হয়েছে।

পুলিশের মামলার ১৪৭ নম্বর আসামী ভট্টাচার্যের বাগ এলাকার বাসিন্দা ছাত্রলীগকর্মী হাসান শেখ। তিনি জানিয়েছেন, সংঘর্ষের সময় জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহমেদ পাভেলের সঙ্গে তার বাসায় ছিলেন। সদর উপজেলার ভিটিহোগলা কান্দি গ্রামের মৃত আবদুর রহমানের ছেলে জামাল হোসেন মালয়েশিয়া প্রবাসী। সম্প্রতি তিনি দেশে ফিরেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ২১ সেপ্টেম্বর তিনি মুক্তারপুরেই ছিলেন না। কিন্তু তাকেও আসামী করা হয়েছে।

পুলিশের মামলায় ৩১৩ জনের নামসহ অজ্ঞাত ৮০০ জনকে আসামী করা হয়েছে। শ্রমিকলীগ নেতার মামলায় ৫২ জনের নামসহ অজ্ঞাত ২০০ জনকে আসামী করা হয়েছে। এজাহারে যাঁদের নাম রয়েছে, তাদের অধিকাংশ বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, শ্রমিকসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মী।

স্থানীয় সূত্র বলছে, কয়েক দফা এজাহার বদল করা হয়েছে। মামলার আসামী করতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের তিনটি পক্ষের কাছ থেকে বিএনপি নেতাকর্মীদের নাম নেওয়া হয়েছে। ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার কারণে তালিকায় সংঘর্ষ স্থলে না থাকা বিএনপির নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের নাম দেওয়া হয়েছে। এজাহার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সদর উপজেলার দুই পৌরসভা ও ৯টি ইউনিয়ন এবং টঙ্গিবাড়ী, লৌহজং, শ্রীনগর, সিরাজদীখান ও গজারিয়া উপজেলার বিএনপি নেতাকর্মীদের আসামী করা হয়েছে।

তবে সংঘর্ষ স্থলে থাকা বিএনপির অনেক নেতাকে আসামী করা হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা বলেছেন, ভবিষ্যতে বিএনপি যাতে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি করতে না পারে, সে জন্য সবাইকে আসামী করা হয়নি।

শাওন হত্যায় মামলা হয়নি: মৃত্যুর চারদিন পার হলেও যুবদল নেতা শাওন নিহত হওয়ার ঘটনায় মামলা হয়নি। সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তারিকুজ্জামান এ তথ্য জানিয়েছেন। শাওনের ছোটভাই সোহান বলেছে, 'মামলা করলে সমস্যা হবে। ভেজালে পড়তে চাইনা। পুলিশ থানায় ডেকে ছিল। কিন্তু আমরা মামলা করবনা। বিএনপি মামলা করতে বললেও মামলা করবনা। এটাই আমাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।'

এজাহারে আছে, বাস্তবে নেই শ্রমিকলীগের কার্যালয়: আবদুল মালেকের দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, মুক্তারপুর শ্রমিকলীগের কার্যালয় ভাঙচুর করেছে বিএনপি। এতে শ্রমিকলীগের কর্মী-সমর্থকরা আহত হয়েছেন।

তবে সরেজমিনে দেখা গেছে, মুক্তারপুর সেতুর ঢালে বাঁশের খুঁটিরও পরে ত্রিপলের একটি ছাউনি রয়েছে। বেড়া হীন এই ছাউনিতে হামলায় পাঁচলাখটাকার ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে বলে মামলার বাদী আবদুল মালেকের অভিযোগ। ছাউনির দক্ষিণে চায়ের দোকান এবং উত্তরে মুক্তারপুর সেতুরওয়ে স্কেলের কার্যালয়। জায়গাটি সেতু বিভাগের সরকারি জায়গা। ছাউনিতে মুক্তারপুর স্ট্যান্ড কমিউনিটি পুলিশের এবং মুন্সিগঞ্জ জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের ব্যানার দেখা যায়।

মামলার প্রধান আসামী সদর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, মুক্তারপুরে শ্রমিকলীগের কার্যালয় নেই। অতিউৎসাহী হয়ে নিজেকে শ্রমিকলীগ নেতা দাবি করে আবদুল মালেক বানোয়াট মামলা করেছেন বিএনপি নেতাকর্মীদের হয়রানি করতে। আবদুল মালেক বলেছেন, শ্রমিকলীগের কার্যালয়ের বয়স ৯ বছর। সেতু বিভাগের জমিতে কীভাবে কার্যালয় বানালেন- প্রশ্নে তিনি বলেছেন, পরিত্যক্ত জায়গায় অস্থায়ী কার্যালয় বানানো হয়েছে বসার জন্য।

জেলা শ্রমিকলীগের আহ্বায়ক আক্কাস আলী জানান, মুক্তারপুর ফেরিঘাট ও সেতু এলাকায় তার সংগঠনের কার্যালয় নেই। সেতুর ঢালে শ্রমিকলীগ নেতা আবদুল মালেক অস্থায়ী কার্যালয় বানিয়েছেন।

বিএনপি নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে: সংঘর্ষের পর থেকেই আত্মগোপনে বিএনপির নেতা কর্মীরা। জেলা কার্যালয়ও কেউ আসছেন না। কার্যালয়টিতে তালা ঝুলছে। স্থানীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, গ্রেফতার এড়াতে গা-ঢাকা দিয়েছেন সকলে। কেউ কেউ উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিনের চেষ্টা করছেন বলেও জানা গেছে।

পুলিশ যা বলছে: এজাহারে মৃত ব্যক্তি, সাংবাদিক, ক্রীড়াসংগঠন, ছাত্রলীগকর্মীর নাম থাকার বিষয়ে ওসি মো. তারিকুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, সংঘর্ষের পর গ্রেফতার ২৪ জনের তথ্যে আসামী করা হয়েছে। তারাই মৃত, প্রবাসী ও ঘটনার সঙ্গে জড়িত নেই- এমন ব্যক্তিদের নাম বলেছে। তদন্ত চলছে। যাঁরা সংঘর্ষে জড়িত নয়, তাদের বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে আদালতে। আওয়ামী লীগের কাছ থেকে তালিকা নিয়ে আসামী করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ওসি।

 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ